ওয়ারেন, ২৫ মে : ‘কেন আসিলে ভালোবাসিলে দিলে না ধরা জীবনে যদি…’ — ব্যর্থ প্রেমের অব্যক্ত আর্তি আর অভিমানে কবি নজরুল ইসলামের লেখা এই গানের পঙ্ক্তিগুলি আজও প্রেমের করুণ অধ্যায়ে এক অনন্য ব্যঞ্জনা হয়ে বাজে।
আজ, ২৫ মে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। বিদ্রোহে যেমন তাঁর কলম ছিল অপ্রতিরোধ্য, তেমনি প্রেম ও বেদনায় তাঁর সুর ছিল মরমী, ছুঁয়ে যেত অন্তর।
বাংলা সাহিত্যে যিনি প্রেমের কোমলতা, মানবতার আহ্বান আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠ একত্রে ধারণ করেছিলেন, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম।
বাংলা সাহিত্যের ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিত নজরুল প্রেমের কবিতায়ও ছিলেন এক শাশ্বত দার্শনিক। প্রেমে জর্জরিত আত্মার আর্তনাদ, বিরহের অশ্রু, আর জীবনের গভীর দুঃখ-ব্যথা—সবই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর গানে ও কবিতায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মাঝে নজরুলের প্রেম ও বেদনার কবিতা আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। নজরুলের প্রেম মানেই কেবল রোমান্স নয়—তা আত্মত্যাগ, আধ্যাত্মিকতা ও মানবিক বোধে পূর্ণ।
উপন্যাস, নাটক, সঙ্গীত আর দর্শনেও নজরুলের অনবদ্য উপস্থিতি বর্ণাঢ্য করেছে বাংলা সাহিত্যকে। কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা, সম্পাদক পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অভিমানী এ মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন নিপীড়িত-অসহায়ের আর্তি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার কবিতা কোটি তরুণের রক্তে জ্বালায় স্ফুলিঙ্গ।
অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (ইংরেজি সাল অনুযায়ী ২৪ মে ১৮৯৯ সাল) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের জীবনের পরতে পরতে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। জড়িয়েছিলেন নানা পেশায়। ১৯১৭ সালে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। অংশ নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও।
এরই মাঝে তৎকালীন প্রভাবশালী কবি-সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। ১৯২২ সালে প্রকাশ করেন ধূমকেতু পত্রিকা। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য নজরুলকে দেওয়া হয় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও বেশির ভাগই সুরারোপ করেছেন- যেগুলো নজরুলসংগীত নামে পরিচিত।
সাহিত্যের পাশাপাশি সংগীত ও চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন নজরুল। নিজের পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘ধ্রুব’তে অভিনয়ও করেছিলেন। তাই শুধু কবি পরিচয়েই আবদ্ধ নন নজরুল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে।
আসানসোলের যে কিশোর একদিন রুটির দোকানে কাজ করতো, সেই ছেলেটাই একদিন হয়ে উঠেছিলো বাংলা সাহিত্যের ‘ধূমকেতু’। আজ তিনি শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার প্রতিটি কবিতা, প্রতিটি গান, প্রতিটি উচ্চারণে তিনি প্রতিদিনই উপস্থিত—ভাষায়, চেতনায়, প্রতিবাদে ও প্রেমে।
তিনি ছিলেন বিদ্রোহের কণ্ঠ, প্রেমের কবি, মানবতার বাণীবাহক—কাজী নজরুল ইসলাম। একজন মানুষ কেবল কলমের জোরে কিভাবে হয়ে উঠতে পারেন সময়ের চেয়েও বড়, তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ নজরুল।
১৯৭২ সালে কবি নজরুলকে সপরিবারে নিয়ে আসা হয় স্বাধীন বাংলাদেশে। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন এই মহাবিদ্রোহী ও প্রেমিক পুরুষ। কবির ইচ্ছানুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan